প্রাসঙ্গিক কথা
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ পাকের জন্য এবং দরূদ ও সালাম মহানবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সা. এর উপর। বণী আদমের আবাস ভূমির পুরোচাতেই যখন বিরাজ করছিল গোমরাহী অন্ধকার তখন আল্লাহ তায়া’লা অন্ধকারাচ্ছন্ন এ ধরায় হেদায়তের আলো বিকিরণে এখানকার মধ্যাকাশে প্রেরণ করেন সর্বাধিক আলোকময় নূরের রবি রহমতে আলম হযরত মুহাম্মদ সা. কে
বিশ্বময় হেদায়তের আলো ছড়িয়ে নূরের এ মহান রবির অস্তাচলে যাওয়ার সন্ধিক্ষণে বিদায় হজ্বে আরাফার ময়দানে সমবেত হলেন তাঁরই পরশে ধণ্য হেদায়তের আলোকবর্তিকা লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরাম। ময়দান জুড়ে পিন পতন নীরবত, আখেরী নবীর নসীহত সমূহ শুনতে সবাই উৎকর্ণ। রহমতে দু’আলম তাঁর নিজ হাতে গড়া সোনালী মানুষদের এ বিশাল সমাবেশে অন্যান্য নসীহতের সাথে এ ঘোষণাও দিয়েছিলেন: ”তোমাদের মধ্যে যারা উপস্থিত তারা অনুপস্থিতদের নিকট আমার বাণী পৌঁছে দেবে”। প্রিয় নবীর এ বাণী অক্ষরে অক্ষরে তা’মীল করলেন নবীর রঙ্গে রঙ্গিন এ সোনালী কাফেলা। দ্বীনের দাওয়াতে বাড়ী-ঘর ছেড়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পৃথিবীর বন্ধুর পথ সমূহ অতিক্রম করে হেরার আলো পৌঁছে দিলেন সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তামাম জাহানের আনাচে-কানাচে। সেই ধারাবাহিকতায় সাত শতাব্দীপূর্বে গৌড় গোবিন্দের অপদখলীয় সিলেটে পদার্পণ করেন নববী আলোয় আলোকিত হযরত শাহজালাল মুজাররদে ইয়ামনী রহ.। তাঁর আগমনে ধন্য হয় সিলেট ভূমি, মদীনার নূরে নূরান্নিত হয় রাম-কৃষ্ণের কালিমায় আচ্ছাদিত এ জমিন।
জামেয়া ক্বাসিমুল উলূমের শিক্ষা ব্যবস্থা ৫টি স্তরে বিভক্ত:
১. মারহালায়ে ইবতেদাইয়্যাহ (প্রথমিক স্তর):
৫ বছর মেয়াদি এ স্তরে মুসলিম শিশুদের তাজবীদসহ সহীহ শুদ্ধভাবে ক্বোরআন মজীদ শিক্ষাদান, দ্বীনের মৌলিক নীতি ও বিধিবিধানসহ যুগ-চাহিদার প্রেক্ষাপটে মাতৃভাষা লিখন ও পঠন এবং প্রারম্ভিক ইংরেজী, অংক, উর্দূ, ভূগোল, সমাজ ও বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে।
২. মারহালায়ে মুতাওয়াসসিতাহ (নিম্ন মাধ্যমিক স্তর):
৪ বছর মেয়াদি এ স্তরে মাদ্রাসা বোর্ডের কারিকুলাম অনুযায়ী আরবী ও উর্দূ সাহিত্যসহ আরবী ব্যাকরণ তথা নাহু-সরফ ইত্যাদি বিষয় সযতনে পাঠদান করা হয়। তাছাড়া আরবী সাহিত্য ও ইলমে মানতেকের প্রাথমিক কিতাবাদি, হানাফী ফেকাহ শাস্ত্রের মৌলিক গ্রন্থবলি, সমকালীন চাহিদা অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরের বাংলা, ইংরেজী, অংক, ইতিহাস, ভূগোল ও পৌরনীতি ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত যত্নসহকারে পড়ানো হয়।
৩. মারহালায়ে ছানাবিয়া (উচ্চ মাধ্যমিক স্তর):
৩ বছর মেয়াদি এ স্তরে আরবী ব্যাকরণ তথা নাহু-সরফের উচ্চ স্তরের কিতাবাদি, আরবী অলংকার শাস্ত্র তথা ইলমে বালাগাত, উচ্চমানের আরবী সাহিত্য, ইলমে মানতেক, ইলমে ফেক্বাহ ও এর মূলনীতি তথা উসূলে ফেক্বাহ, সংক্ষিপ্ত তাফসীর, ফরায়েজ শাস্ত্র ও ইসলামী ইতহাস ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
৪. মারহালায়ে ফযীলত (স্নাতক স্তর):
২ বছর মেয়াদি উক্ত স্তরে ইলমে তাফসীর, ইলমে হাদীস, ইলমে ফেক্বাহ ও আরবী সাহিত্যের উচুঁ স্তরের কিতাবাদি এবং ইসলামী রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ফালসাফা ও ইলমে কালাম বা আকাইদ শাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ের উপর পাঠদান করা হয়।
৫. মারহালায়ে তাকমীল (স্নাতকোত্তর):
পুরো একটি বছর দিবা-রাত ক্লাশ গ্রহণের মাধ্যমে ইলমে হাদীসের সিহাহ সিত্তা তথা বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, তিরমিযী শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, নাসায়ী শরীফ, ইবনে মাজা শরীফ, সহ তাহাভী শরীফ, শামায়েলে তিরমিযী, মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক, মুয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদ এর মত গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলোর পাঠদান করা হয়।
তাখাস্সুস ফিল ফিক্বাহ ওয়াল ইফতা:
মারহালায়ে ছানাবিয়া ও মারহালায়ে ফযীলতে মেধা-তালিকায় এবং মারহালায়ে তাকমীল তথা টাইটেল ক্লাসে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ যে সব ছাত্র উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় তাদের জন্য এ জামেয়া ১৪১৬ হিজরী সন থেকে চালু করেছে দুই বছর মেয়াদি এক গবেষণা কোর্স। যার নাম তাখাস্সুস ফিল ফিক্বাহ ওয়াল ইফতা। এ কোর্সে অধ্যয়নরত ছাত্রদেরকে সমকালীন সমস্যা সমূহের ক্বোরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ফতওয়া প্রদানে যোগ্য করে গড়ে তোলা হয়।
জামেয়ার ছাত্রাবাস
জামেয়ার রয়েছে একাধিক বিল্ডিং বিশিষ্ট ছাত্রাবাস। যাতে বর্তমানে সাড়ে সাত শত আবাসিক ছাত্র অবস্থান করে। তাদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা খরচ, জামা-কাপড় ও অধ্যয়নের কিতাবাদিসহ যাবতীয় ব্যয়ভার জামেয়া বহন করে থাকে। লিল্লাহ বোর্ডিং-এ অবস্থানরত ছাত্র ছাড়াও আরো তিন শতাধিক ছাত্র এ জামেয়ায় শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।
শিক্ষকমণ্ডলী ও কর্মচারী বৃন্দ:
বার্তমানে জামেয়ায় ৩৪ জন দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক এবং ২৬ জন কর্মচারী রয়েছেন।
জামেয়া গ্রন্থাগার
জামেয়া ক্বাসিমুল উলূমের রয়েছে একটি স্বতন্ত্র বিশাল গ্রন্থাগার। যাতে বর্তমানে পনের হাজারের ও বেশী কিতাব রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দুষ্প্রাপ্য কিতাবাদির এ বিশাল খাজানার ইসলামী ও যুগোপযোগী গ্রন্থাবলির মাধ্যমে ইল্ম আহরণকারী জ্ঞান-পিপাসুদের অন্তরাত্না প্রশান্তি পায়।
জামেয়ার ফারেগীন
এ জামেয়া তার সূচনালগ্ন থেকেই প্রতি বছর আসহাবে সুফ্ফার আদলে গড়ে তুলছে নববী রঙ্গে রঙ্গিন এক ঝাঁক সোনালী কাফেলা। যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওয়াজ-নসীহত, লেখনী, বক্তৃতা, শিক্ষকতাসহ রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে বিভিন্নভাবে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
জামেয়ার ভবিষ্যত পরিকল্পনা:
এ জামেয়া ইতঃমধ্যেই দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। জামেয়ার এ অবস্থানকে গতিময় করতে জামেয়া কর্তৃপক্ষ নিম্নোক্ত পরিকল্পনা সমূহ হাতে নিয়েছে:
১. পৃথক ক্বিরাআত ও তাজবীদ বিভাগ চালু করা।
২. হাদীস শাস্ত্রের উপর বিশদ গবেষণার নিমিত্তে তাখাস্সুস ফিল হাদীস বিভাগ চালু করা।
৩. পবিত্র ক্বোরআন মজীদ নিয়ে গবেষণা কল্পে তাখাস্সুস ফি উলূমুল ক্বোরআন বিভাগ চালু করা।
৪. আরবী ভাষার উপর গভীর জ্ঞানার্জনের নিমিত্তে আরবী আদব (সাহিত্য) বিভাগ চালু করা।
এ সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আরো অনেক গবেষণামূলক কিতাবাদি, প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি, স্বতন্ত্র গবেষণাগার নির্মাণ একান্ত আবশ্যক।
জামেয়ার অন্যান্য কার্যক্রম
১. তাখাস্সুস ফিল ফিক্বাহ ওয়াল ইফতা:
মারহালায়ে ছানাবিয়া ও মারহালায়ে ফযীলতে মেধা-তালিকায় এবং মারহালায়ে তাকমীল তথা টাইটেল ক্লাসে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ যে সব ছাত্র উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় তাদের জন্য এ জামেয়া ১৪১৬ হিজরী সন থেকে চালু করেছে দুই বছর মেয়াদি এক গবেষণা কোর্স। যার নাম তাখাস্সুস ফিল ফিক্বাহ ওয়াল ইফতা। এ কোর্সে অধ্যয়নরত ছাত্রদেরকে সমকালীন সমস্যা সমূহের ক্বোরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ফতওয়া প্রদানে যোগ্য করে গড়ে তোলা হয়।
২. হিফজ বিভাগ:
জামেয়া তার সূচনালগ্ন থেকেই ছাত্রদেরকে সহীহ শুদ্ধভাবে ক্বোরআন মজীদ শিক্ষা দেয়ার পাশা-পাশি পৃথক হিফজ শাখার মাধ্যমে হাফিজ বানানোর উপরও গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বিগত ১৩১৩ হিজরী থেকে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সংলগ্ন ধূপাগুলে দুইজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে একটি স্বতন্ত্র হিফজ শাখা ও চালু রয়েছে।
৩. প্রাতঃকালীন মক্তব:
জামেয়া তার সূচনা লগ্ন হতেই পাড়া-প্রতিবেশী কোমলমতি মুসলিম শিশুদের দ্বীনী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে আসছে। সে লক্ষ্যে প্রাতঃকালীন মক্তব চালু করে দু’জন অভিজ্ঞ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিশুদের কালিমা, মাসনুন দুআ’ সমূহ, ওজু, তায়াম্মুম ও নামাজ ইত্যাদি নিয়ামাবলি এবং সহীহ শুদ্ধভাবে কায়দা, ছিপারা ও ক্বোরআন মজীদ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রেখেছে।
৪. দাওয়াত ও তাবলীগ:
দাওয়াত ও তাবলীগ দ্বীন ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিততের ছাড়াও জন সাধারণের দোর গোড়ায় সহজেই ইসলামের বানী পৌঁছে দেয়া যায়। আলহামদু লিল্লাহ! এ ক্ষেত্রে জামেয়ার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। জামেয়ার শিক্ষকবৃন্দ ও পূর্ণ যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জামে মসজিদ ও দ্বীনী মজলিসে দ্বীন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বয়ান পেশ করে থাকেন।
শেষ কথা
একমাত্র তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ-ই জামেয়ার মূল সম্বল। আল্লাহর রহমতে জামেয়া তার এ বিশাল ব্যয়ভার দ্বীন-দরদী মুসলিম মিল্লাতের দান-খয়রাতের মাধ্যমেই বহন করে আসছে। এর স্থায়ী কোন আয়ের উৎস নেই। নেই কোন সরকারী বরাদ্ধকৃত তহবিলও। আলহামদু লিল্লাহ! এতদসত্ত্বেও জামেয়া দিন দিন তার লক্ষ্যপানে জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে।
আকুল আবেদন
দ্বীন দরদী মুসলিম ভাই ও বোনেরা! এ জামেয়া শুরু থেকেই আপনাদের দান-খয়রাতের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। আলহাম্দু লিল্লাহ! আপনাদের এ জামেয়ার লেখাপড়ার মান উন্নত হওয়ায় আবহমান বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে এর সুনাম-খ্যাতি। কুতবে আলম শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাংলার প্রাচীনতম দ্বীনী শিক্ষা বোর্ড ”আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ” এর শীর্ষ স্থানটি দখল করে আছে আপনাদের প্রাণপ্রিয় এ জামেয়া। যদ্দরুন প্রতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতে জ্ঞান-পিপাসুদের উপচে পড়া ভীড়ে স্থান সংকুলান হয়না এর ছাত্রাবাস ও শ্রেণী কক্ষ সমূহে। ছাত্রাবাস ও শ্রেণীকক্ষ সংকটের দরুন প্রতি বৎসর বাধ্য হয়েই প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ভর্তিচ্ছু ছাত্রকে ফেরত দিতে হয়। সম্পূর্ণ অবৈতনিক এ জামেয়া অবস্থানরত এতীম, গরীব ও মেধাবী ছাত্রদের থাকা-খাওয়া, জামা-কাপড়, চিকিৎসা, কিতাবাদি ছাড়াও মাসিক ওজিফা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে লিল্লাহ বোর্ডিং ফান্ড হতে।
তাই দ্বীন দরদী মুসলিম ভাইবোনদের প্রতি আকুল আবেদন যে, অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও জামেয়ার প্রতি আপনাদের দান-খয়রাতের হাত সম্প্রসারিত করে ছদকায়ে জারিয়ার অফুরন্ত সাওয়াবে অংশ গ্রহণ করবেন।
আল্লাহ তায়া’লা আপনাদের দান কবুল করুন এবং দিন দিন জামেয়ার উন্নতি দান করুন। আমীন।
সালামান্তে,
মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া
মুহতামিম, জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম,
দরগাহে হযরত শাহ জালাল রহ. সিলেট, বাংলাদেশ।